বুধবার, ১৩ জুন, ২০১২

প্রেমিক নজরুল ও কুমিল্লা


কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা কবিতায় একাধারে প্রেম, দ্রোহ ও প্রকৃতির অনুপম সমন্বয় ঘটিয়েছেনব্যক্তিগত জীবনেও দুর্দান্ত প্রেমিক ছিলেন কবি নজরুলপ্রেমের সঙ্গে তার কোনো আপস ছিল নানজরুলের জীবনে নারীপ্রেম এসেছিল মূলত তিনবার প্রথমবার নার্গিস, দ্বিতীয় স্ত্রী প্রমিলা দেবী এবং তৃতীয় বেগম ফজিলাতুন্নেসাআর নার্গিসের সঙ্গে কবির প্রথম প্রেমের সূত্রপাত এবং প্রমীলার সঙ্গে বিয়ের পুরোটা জুড়েই রয়েছে কুমিল্লাকাজী নজরুল ইসলামের যৌবনের কিছুটা সময় কেটেছে কুমিল্লার মুরাদনগরের দৌলতপুরেমোট পাঁচবারে সেখানে প্রায় ১১ মাসেরও বেশি সময় কাটিয়েছেন কবিজীবনের দীর্ঘযাত্রায় এতটুকু সময় খুব বেশি না হলেও কুমিল্লার মাটি ও মানুষ তার অস্তিত্বে গভীর নোঙর বেঁধেছিল ঠিকইনার্গিস ও প্রমীলার সঙ্গে শুধু বৈবাহিক বন্ধনই নয়, সেখানে একবার ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর হাতে গ্রেফতারও হয়েছেন কবিতরুণ কবি নজরুল ১৯২১ সালের এপ্রিলে কুমিল্লার দৌলতপুরে আলী আকবর খানের বাড়িতে অতিথি হয়ে আসেনসেখানে বাড়ির পাশের কামরাঙা গাছতলায় বাঁশিতে সুর তুলে, আর পুকুরঘাটে বসে কবিতা লিখে লিখে সময় কেটেছে তারনজরুলের প্রথম প্রেম সৈয়দা খানম (নজরুল তাকে নাম দেন নার্গিস, ফার্সি ভাষায় যার অর্থ গুল্ম)তিনি কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর থানার দৌলতপুর গ্রামের মেয়ে ছিলেনপ্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকালে নার্গিসের মামা ক্যাপ্টেন আলী আকবর খানের সঙ্গে পরিচয় ঘটে নজরুলের১৯১৯ সালে যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়নজরুল তখন মুসলিম সাহিত্য সমিতির (কলকাতা) অফিসে আফজাল-উল হকের সঙ্গে থাকতেনওই সময় আলী আকবর খানের সঙ্গে হৃদ্যতা গড়ে ওঠেআকবর খান নজরুলের প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে তাকে কুমিল্লায় তার গ্রামের বাড়িতে ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানানআলী আকবর খানের আমন্ত্রণ রক্ষা করতে কলকাতা থেকে ১৯২১ সালের ৩ এপ্রিল চট্টগ্রাম মেইলে নজরুল কুমিল্লা এসে পৌছেনময়মনসিংহের ত্রিশাল ছাড়ার পর এটিই ছিল নজরুলের প্রথম পূর্ববঙ্গ যাত্রাযাওয়ার পথে তিনি 'নিরুদ্দেশ যাত্রা' কবিতাটি লেখেনট্রেনে কুমিল্লা পৌছে নজরুলকে নিয়ে আলী আকবর খান তার স্কুলের বন্ধু বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাসায় ওঠেনচার-পাঁচদিন সেখানে কাটিয়ে কবি রওয়ানা দেন দৌলতপুরের খাঁ বাড়ির উদ্দেশেতবে সেই চার-পাঁচ দিনেই সেনবাড়ির সবাই বিশেষ করে বিরজাদেবীর সঙ্গে নজরুলের সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে নজরুল তাকে 'মা' সম্বোধন করতেনদৌলতপুরে নজরুলের জন্য আলী আকবর খানের নির্দেশে উষ্ণ অভ্যর্থনার ব্যবস্থা করা হয়বাড়ির জ্যেষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে খুব অল্প সময়ের মধ্যে গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে নজরুলেরকবিতা শুনিয়ে, গান গেয়ে তাদের তো বটেই দূরদূরান্ত থেকেও লোকজন ছুটে আসত কবির নৈকট্য লাভের আশায়আলী আকবর খানের বোন আসমাতুন্নেসার বিয়ে হয়েছিল খাঁ বাড়ির পাশেই অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ থাকায় আসমাতুন্নেসা তার ভাইয়ের বাড়িতে তেমন সমাদর পেতেন নাআসমাতুন্নেসার স্বামী মুন্শী আবদুল খালেক একটি মেয়ে রেখেই মৃত্যুবরণ করেনআর সেই মেয়েটিই কবি নজরুলের প্রথম প্রেম নার্গিস নার্গিসের সঙ্গে কবির আলোচনার সূত্রপাত ঘটেছিল কবির বাঁশি বাজানো নিয়েএক রাতে কবি খাঁ বাড়ির দীঘির ঘাটে বসে বাঁশি বাজাচ্ছিলেন, সেই বাঁশির সুরে মুগ্ধ হন নার্গিসএকদিন নজরুলকে এসে শুধান, 'গত রাতে আপনি কি বাঁশি বাজিয়েছিলেন? আমি শুনেছি'এই পরিচয়ের পরই নজরুল নার্গিসের প্রতি আকৃষ্ট হতে লাগলেনবিষয়টি আলী আকবর খানেরও চোখ এড়াল নাএতে অবশ্য তিনি খুশিই হয়েছিলেনকেননা এ রকম একটা কিছুই চেয়েছিলেন আলী আকবরফলে তার পরামর্শে নার্গিসের খাঁ বাড়িতে আসা-যাওয়া বাড়তে থাকেখাঁ বাড়ির মুরব্বীরা নার্গিসের বর হিসেবে নজরুলকে তেমন পছন্দ করতেন নানজরুলকে তারা ছিন্নমূল বাউণ্ডুলে হিসেবেই দেখেছিলেনকিন্তু গ্রাজুয়েট আলী আকবর খানের চাপে তারা প্রতিবাদ করতেন নাএক পর্যায়ে খোদ নজরুলই বিয়ের প্রস্তাব উত্থাপন করলেনফলে ১৩২৮ খ্রিস্টাব্দের ৩ আষাঢ় বিয়ের দিন ধার্য করা হয়এরপর শুরু হয় নাটকীয়তাআলী আকবর খান তার গ্রাম্য ভগিনীকে বিখ্যাত কবি নজরুলের জন্য গড়তে নেমে পড়লেন অশিক্ষিত নার্গিসকে খুব কম সময়ে শিক্ষিত করে তোলা সম্ভব ছিল নাকিন্তু তিনি শরৎচন্দ্র ও অন্যান্য সাহিত্যিকের উপন্যাসের নারী চরিত্রগুলো থেকে নার্গিসকে জ্ঞান দিতে থাকলেননজরুলের এসব ভনিতা একেবারেই পছন্দ ছিল না, তিনি আলী আকবর খানকে তা জানালেও তিনি নজরুলকে পাত্তা দেন নাসেইসঙ্গে খুব দ্রুত বিয়ের প্রস্তুতি নিতে থাকেন, নিমন্ত্রণপত্রও অতিথিদের মাঝে বিলিয়ে ফেলেনএসব ব্যাপার নজরুলকে পীড়া দেয়, আস্তে আস্তে তার মোহ ভাঙতে থাকেএর ফাঁকে আলী আকবর খান সবার অগোচরে আরও একটি কাজ করে যাচ্ছিলেনতিনি নজরুলের জন্য কলকাতা থেকে আসা বন্ধুদের সব চিঠিই সরিয়ে ফেলতেন, সেইসঙ্গে নজরুলের পাঠানো চিঠিও পোস্ট না করে নিজের কাছে রেখে দিতেনএদিকে নজরুল বিয়েতে তার পক্ষের অতিথি হিসেবে বিরজাসুন্দরী দেবী ও তার পরিবারকে মনোনীত করেনবিয়ের আগের দিন সবাই দৌলতপুরে এসে উপস্থিত হনকলকাতায় নজরুলের বন্ধুদের এমন সময় দাওয়াত দেওয়া হয় যেন কেউ আসতে না পারেকবির অন্যতম ঘনিষ্ঠ বন্ধু কমরেড মোজাফফর আহমেদ নিমন্ত্রণপত্র পান বিয়ের পরেএরপর এল সেই বহু প্রতীক্ষিত ৩ আষাঢ়যতদূর জানা যায়, বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয় এবং আকদ্ও সম্পন্ন হয় কিন্তু কাবিনের শর্ত উল্লেখ করার সময়ই ঝামেলা বাধেআলী আকবর খান শর্ত জুড়ে দেন যে, নজরুলকে ঘরজামাই থাকতে হবেবাঁধনহারা নজরুল এই শর্ত প্রত্যাখ্যান করেনআকদ্ হয়ে যাওয়ার পর আনুষ্ঠানিক অন্যান্য কাজে যখন সবাই ব্যস্ত তখন নজরুল অন্তর্দ্বন্দ্বে বিক্ষুব্ধতিনি ছুটে যান বিরজাসুন্দরী দেবীর কাছে তাকে বলেন, 'মা, আমি এখনই চলে যাচ্ছি'বিরজাসুন্দরী দেবী বুঝতে পারেন এই অবস্থায় নজরুলকে ফেরানো সম্ভব নয়তিনি তার ছেলে বীরেন্দ্রকুমারকে নজরুলের সঙ্গে দিয়ে দেনসেই রাতে দৌলতপুর থেকে কর্দমাক্ত রাস্তা পায়ে হেঁটে নজরুল ও বীরেন্দ্রকুমার কুমিল্লা পৌছেপরিশ্রম ও মানসিক চাপে নজরুল অসুস্থ হয়ে পড়েননজরুলের জীবনে নার্গিস অধ্যায় সেখানেই শেষ হয়

১৯২১ সালের জুলাই মাসে নজরুল আলী আকবর খানকে চিঠি দেনএরপর ১৯২১-এর সেপ্টেম্বরে আলী আকবর খান কলকাতা পৌছে নজরুলের সঙ্গে দেখা করেননজরুলকে তিনি টাকার লোভ দেখান, এতে নজরুল আরও রেগে যানএরপর থেকে দীর্ঘ ১৬ বছর নজরুলের সঙ্গে নার্গিসের আর কোনো যোগাযোগ হয়নি ১৯৩৭ সালে নজরুলকে নার্গিস একটি চিঠি লেখেনচিঠি প্রাপ্তির সময় সেখানে শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় উপস্থিত ছিলেন নজরুল তাকেই চিঠি পড়তে বলেনচিঠি পড়া শেষে শৈলজানন্দ নজরুলকে উত্তর লিখতে বলেননজরুল একটি গান লিখে দেন১৯৩৭ সালের ১ জুলাই নজরুল নার্গিসকে আর একটি চিঠি লেখেনএর প্রায় বছরখানেক আগেই শিয়ালদহতে নার্গিস ও নজরুলের উপস্থিতিতে উভয়ের আনুষ্ঠানিক বিবাহবিচ্ছেদ ঘটেবিচ্ছেদের সাত-আট মাসের মাথায় আলী আকবর খানের বই ব্যবসার ম্যানেজার আজিজুল হাকিমের সঙ্গে নার্গিসের বিয়ে হয়আজিজুল হাকিমও বাংলা সাহিত্যে কবি হিসেবে সমাদৃতএকসময় তিনিই নার্গিসের কাছ থেকে পাওয়া সেই ১৯২১ সালে আলী আকবর খানের সরিয়ে ফেলা নজরুলের বন্ধুদের ও বন্ধুদের কাছে লেখা চিঠিগুলো প্রকাশ করেনআলী আকবর খানের মূল চরিত্র জনসম্মুখে প্রকাশিত হয়শচীন দেব বর্মণের সঙ্গে সংগীতচর্চা এবং একটা সুসম্পর্ক ছিল কবিরসেই সূত্রে কুমিল্লার কান্দিরপাড়ের ইন্দ্রকুমার সেনের বাড়িতে ১৯২১ থেকে ১৯২৩ সালের বিভিন্ন সময়ে অবস্থান করেন কবিএ সময় কংগ্রেসের নেতাদের কাছ থেকে রাজনৈতিক শিক্ষা নিতেন তিনিসেখানেই ইন্দ্রকুমারের ভাইয়ের মেয়ে আশালতা সেনগুপ্তা ওরফে প্রমীলা দেবীর সঙ্গে তার পরিচয় হয়, যা পরে পরিণয়ে রূপ নেয়এর মধ্যে ১৯২১ সালের ২১ নভেম্বর ব্রিটিশ নেতা ইংল্যান্ডের প্রিন্স অব ওয়েলসের ভারত সফরের প্রতিবাদে জাগরণী গান গাওয়ার অভিযোগে কবি নজরুলকে গ্রেফতার করা হয়পরে ১৯২২ সালের ২৩ ডিসেম্বর 'আনন্দময়ীর আগমনে' কবিতার জন্য তাকে শহরের ঝাউতলা এলাকা থেকে গ্রেফতার করে কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়নজরুলের দৌলতপুরে আগমন যেমন তার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, তেমনি বাংলা সাহিত্যের জন্যও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণকুমিল্লার আতিথ্য নজরুলকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছেসেখানে বসে তিনি দোলনচাঁপা, ছায়ানট, ঝিঙ্গেফুল, চক্রবাকসহ ৫০টির বেশি গান ও কবিতা লিখেছেনএসব গান ও কবিতায় ফুটে উঠেছে প্রেম আর দ্রোহ
সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন